বাসায়-অফিসে থাইগ্লাস লাগানোর কাজ করতেন ১৯ বছর বয়সি রিপন আহমদ। অসচ্ছল টানাপোড়েনের সংসারের হাল ধরতে বিদ্যালয়ের গণ্ডি ছেড়েছিলেন সপ্তম শ্রেণিতে উঠেই। বাবা অসুস্থ, চার ভাইবোনসহ ছয়জনের সংসারের ঘানি টানতে লড়াই করছিলেন তিনি। গত ৪ আগস্টে তারুণ্যের টগবগে রক্ত টেনে নিয়েছিল বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মিছিলে। এ সময় তার বাম পায়ে গুলি লাগে। এখন হাসপাতালের বিছানায় অনিশ্চয়তায় দিন কাটছে রিপনের।
সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার কুরবাননগর ইউনিয়নের মাইজবাড়ির বদিপুরের বাসিন্দা মো. কামাল উদ্দিনের বড় ছেলে রিপন আহমদ। অভাবেব সংসারে দিনমজুরের কাজ করে চার ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে নিজের সর্বোচ্চ দিয়ে চেষ্টা করছেন তিনি। অসুস্থ থাকায় ভারি কাজ করতে এখন অক্ষম তিনি। তবুও টুকটাক কাজ করে সন্তানদের পড়াশোনা ও পরিবারের খরচ চালিয়ে যাচ্ছিলেন তিনি।
পরিবারের বড় ছেলে রিপন। মাইজবাড়ি সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছিলেন। এ সময় অভাবেব কারণে অষ্টম শ্রেণিতে আর পড়া হয়নি। অন্য তিন ছোট বোনদের পড়াশোনা যেন থেমে না যায়, সে জন্য কাজ শেখা শুরু করেন একটি দোকানে। সেখানে কিছুদিন কাজ করে নিজেই কাজ শুরু করেন তিনি। তবুও অভাব পিছু ছাড়েনি তাদের।
গত ৪ আগস্টে উত্তাল হয়ে উঠে পুরো সুনামগঞ্জ। শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ মিছিলের শুরুতেই শহরের পুরাতন বাসস্টেশন এলাকায় হামলা করে আওয়ামী লীগসহ অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংর্ঘষের সময় ছররা গুলি নিক্ষেপ করে পুলিশ। বিকেল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত থেমে থেমে চলে ত্রিমুখী সংঘর্ষ। দুপুর আড়াইটার দিকে জামতলার সামনে আরপিননগর সড়কে সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার ওসি মো. খালেদ চৌধুরী নিজেই তাকে গুলি করেছেন বলে দাবি করেছেন বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শিক্ষার্থীরা।
শিক্ষার্থীরা জানায়, গুলিতে রিপনের পায়ের গোড়ালি দুমড়েমুচড়ে যায়। বাঁচাও বাঁচাও বলে সে চিৎকার করতে থাকে। আক্রান্ত জায়গায় বাঁ-হাতে চেপে ধরে মোবাইল ফোনে নিজেই মাকে জানায়, ‘আমারে বাঁচাও, আমার পা’র মাঝে গুলি মারছে।’ পরিস্থিতি বুঝতে পেরে পুলিশ সদস্যরা সরে পড়েন। পরে একটি রিকশায় করে একা একাই হাসপাতালের দিকে রওনা দেন রিপন।
এদিকে পরিবারের উপার্জনকারী ব্যক্তির এমন পরিণতিতে মানবেতর জীবনযাপন করছেন অন্য সদস্যরা। পরিবারের অন্যরা জানিয়েছেন, সিলেট ও ঢাকায় চিকিৎসার খরচ কিছুদিন ধার করে দিয়েছেন তারা। এখন সরকারিভাবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
রিপনের বাবা মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ছেলের আয় দিয়েই পরিবার চলত। এখন সে অসুস্থ, খুব কষ্টে আছি আমরা। কিছুদিন পাড়া-প্রতিবেশীদের সহযোগিতা ও সুদে টাকা এনে চিকিৎসা করিয়েছি। এখন সরকারিভাবে চিকিৎসা চলছে। ৭০ হাজার টাকা ঋণ করেছি। সেই ঋণের সুদের জন্য পাওনাদার তাগাদা দিচ্ছে। বলেছি, ছেলে সুস্থ হয়ে ফিরে আসলে টাকা পরিশোধ করব।
সুনামগঞ্জ পুলিশ সুপার এমএন মোর্শেদ বলেন, আমরা এই বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটি করেছি। এই কমিটির কার্যক্রম চলমান রয়েছে। প্রতিবেদনে আমাদের কারো দোষ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তার চিকিৎসার বিষয়েও সহায়তা করব আমরা।