Saturday, July 5, 2025

যেখানে খুশি যান, ভারতে না-এলেই হলো!

আরও পড়ুন

বহু বছর ধরে ভারতের সবচেয়ে প্রিয় বিদেশি অতিথিদের অন্যতম হলেন শেখ হাসিনা। তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীই থাকুন বা বিরোধী নেত্রী, কিংবা ব্যক্তিগত জীবনে চরম বিপদের মুহুর্তে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী – বিগত প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে দিল্লির দরজা তার জন্য সব সময় অবারিত থেকেছে। সেটা ইন্দিরা গান্ধীর জমানাতে যেমন, তেমনি বাজপেয়ী-মনমোহন সিং বা নরেন্দ্র মোদীর আমলেও।

কিন্তু সোমবার সন্ধ্যায় এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনাকে নিয়ে বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের একটি সামরিক বিমান দিল্লির উপকণ্ঠে অবতরণ করার পর যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তার জন্য দিল্লি একেবারেই প্রস্তুত ছিল না।

বস্তুত এই অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতি ভারত সরকারকে এতটাই অপ্রস্তুত ও হতচকিত করেছে যে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে আনুষ্ঠানিক একটি বিবৃতি দিতেও তারা চব্বিশ ঘণ্টারও বেশি সময় নিয়েছে। অথচ এই সময় পার্লামেন্টের অধিবেশন চলছিল, যেখানে সরকার প্রতিটি ছোটবড় ঘটনা নিয়ে জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকে।

সোমবার রাতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সভাপতিত্বে ক্যাবিনেটের নিরাপত্তা বিষয়ক কমিটি বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করতে জরুরি বৈঠকেও বসেছিল – সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন-সহ সিনিয়র কর্মকর্তারা সবাই উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ নিয়ে ভারত ঠিক কী করবে, ওই বৈঠকে সে ব্যাপারেও কোনও নির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়নি।

এমন কী বিবিসি জানতে পেরেছে, শেখ হাসিনা যতটুকু সময়ই দিল্লিতে থাকুন – প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার সঙ্গে প্রকাশ্যে সাক্ষাৎ করবেন কি না অথবা করলেও সেই বৈঠকের কথা প্রকাশ করা হবে কি না, সে ব্যাপারেও এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নিয়ে ওঠা যায়নি। অথচ শেখ হাসিনা নিজে এই দেখা করার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন।

আরও পড়ুনঃ  হাসিনার পতনের পর শেখ পরিবারের কে কোথায়?

দিল্লিতে একাধিক পর্যবেক্ষক বিবিসি বাংলাকে জানিয়েছেন, সামগ্রিকভাবে এই পরিস্থিতি ভারত সরকারকে একটা ‘ক্যাচ টোয়েন্টি টু সিচুয়েশন’ বা চরম উভয় সংকটে ফেলে দিয়েছে, এ কথা মনে করার যথেষ্ঠ কারণ আছে।

আর এই বিপদটা আসছে দু’দিক থেকে – এক, ব্যক্তি শেখ হাসিনার ক্ষেত্রে দিল্লি কী পদক্ষেপ নেবে আর দুই, বাংলাদেশের ভেতরে যা ঘটছে সেটাকেই বা দিল্লি কীভাবে অ্যাড্রেস করবে।

যেমন, শেখ হাসিনাকে দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়াটা ভারতের উচিত হবে কি না, তা নিয়েও ভারতে দুরকম মতামত শোনা যাচ্ছে। অনেকে যেমন এর পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন, আবার এর বিপক্ষেও মত দিচ্ছেন কেউ কেউ।

আবার বাংলাদেশের ভেতরে এই মুহূর্তে যে ধরনের পরিস্থিতির খবর আসছে, সেখানে দিল্লির কী করণীয় আছে তা নিয়েও পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের মধ্যে স্পষ্ট দ্বিমত আছে।

একদল মনে করেন, বাংলাদেশে এখন যে ধরনের ভারত-বিরোধিতার ঝড় দেখা যাচ্ছে তাতে ভারত অতি-সক্রিয়তা দেখাতে গেলে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে যাবে। সে দেশে ভারতীয় স্থাপনা, ভারতের শিল্প বা ভারতীয় নাগরিকদের আরও বড় বিপদের মুখে ঠেলে দেওয়া হবে এবং ভারত-বিরোধিতা আরও বেশি ইন্ধন পাবে বলে তাদের যুক্তি।

দিল্লিতে বর্তমানে অন্য আর একটি মতবাদ হল, ভারত যদি বাংলাদেশের এই পরিস্থিতি দেখেও চুপচাপ হাত গুটিয়ে থাকে তাহলে ঘরের পাশে আর একটি মৌলবাদী শক্তির উত্থান অবধারিত, এমন কী লক্ষ লক্ষ হিন্দু শরণার্থীর ধাক্কা সামলানোর জন্যও ভারতকে প্রস্তুত থাকতে হতে পারে।

আরও পড়ুনঃ  পুলিশের গুলিতে ছাত্রলীগ নিহত

সরকারিভাবে ভারত অবশ্য এখনও ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ – অর্থাৎ পরিস্থিতির দিকে সতর্ক নজর রাখার কৌশল নিয়েই এগোচ্ছে, কিন্তু এই পাল্টাপাল্টি যুক্তিতর্কগুলো ভারতকে যে প্রবল দ্বিধাদ্বন্দ্বে ফেলেছে তাতে কোনও সংশয় নেই।

শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে এই যুক্তিগুলো কী, এই প্রতিবেদনে সেটাই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়া উচিত হবে?
সোমবার বিকেলে যখন শেখ হাসিনার গতিবিধি নিয়ে তখনও চরম অনিশ্চয়তা, ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনার ছিলেন এমন একজন সাবেক শীর্ষস্থানীয় কূটনীতিবিদকে মেসেজ করেছিলাম, “শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে ঢাকা ছেড়েছেন জানতে পারছি, আপনি কিছু শুনেছেন?”

সঙ্গে সঙ্গে তিনি সংক্ষিপ্ত জবাব দেন, “যেখানে খুশি যান, ভারতে না-এলেই হল!”

বাংলাদেশে রাজনৈতিক সংকটের জেরে শেখ হাসিনাকে ভারতে পালিয়ে আসতে হলে সেটা নিয়ে যে দিল্লিতেই একটা প্রবল দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করবে, তা তার ওই মন্তব্যেই স্পষ্ট ছিল।

দিল্লির থিঙ্কট্যাঙ্ক আইডিএসএ-র সিনিয়র ফেলো তথা বাংলাদেশ গবেষক ম্ম্রুতি পট্টনায়ক এই কথাটাই আবার বলছেন একদম চাঁছাছোলা ভঙ্গীতে।

“আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি শেখ হাসিনা যদি ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চান, তাহলেও ভারতের উচিত হবে না সেটা মঞ্জুর করা”, এদিন একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন।

ড: পট্টনায়ক যুক্তি দিচ্ছেন, বাংলাদেশে সম্প্রতি সরকারের বিরুদ্ধে যে তীব্র আন্দোলন হয়েছে তার একটা স্পষ্ট মাত্রা ছিল ভারত বিরোধিতা।

আরও পড়ুনঃ  বাবা-মায়ের ঝগড়া থামাতে থানায় শিশু

ভারতকে যেহেতু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে শেখ হাসিনা সরকারের সবচেয়ে বড় সমর্থক হিসেবে দেখা হত, তাই হাসিনা বিরোধিতার আন্দোলনে স্বভাবতই মিশে ছিল ভারত-বিরোধিতার উপাদান।

“এই পটভূমিতে ভারত যদি তাকে এখন রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়, সেটা একটা ভুল বার্তা দেবে এবং বাংলাদেশের ভেতরে ভারত বিরোধিতাকে আরও উসকে দেবে”, জানাচ্ছেন স্ম্রুতি পট্টনায়ক।

ওপি জিন্দাল গ্লোবাল ইউনিভার্সিটিতে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত আবার যুক্তি দিচ্ছেন, ১৯৭৫-এ যে পটভূমিতে শেখ হাসিনাকে ইন্দিরা গান্ধী সরকার ভারতে আশ্রয় দিয়েছিল তার চেয়ে এখনকার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ আলাদা।

“তখন যেটা সম্ভব ছিল, এখন সেটা সম্ভব নয়। সে সময়কার মতো শেখ হাসিনাকে তো আর পান্ডারা রোডের একটা ফ্ল্যাটে কার্যত কোনও নিরাপত্তা ছাড়াই রাখা যাবে না, এখন সম্পূর্ণ অন্য ব্যবস্থা করতে হবে।”

“আর শেখ হাসিনা তসলিমা নাসরিনও নন যে দিল্লি পুলিশের পাহারায় শহরের কোনও ফ্ল্যাটে তাকে রাখা যাবে। আর এই সিদ্ধান্তের ‘জিওপলিটিক্যাল রিস্ক’-টাও অনেক বেশি, সেটাও মাথায় রাখতে হবে”, বিবিসিকে বলছিলেন তিনি।

এই পর্যবেক্ষকরা দীর্ঘমেয়াদে শেখ হাসিনাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার বিরুদ্ধে যুক্তি দিলেও সম্পূর্ণ অন্য কথা বলেছেন ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা।

“তিনি যদি কোনও কারণে ভারতে থাকতে চান, তার মর্যাদা ও সম্মান অনুযায়ী যথাযথ পর্যায়ে (অ্যাপ্রোপ্রিয়েট লেভেল) তার সঙ্গে আমাদের এনগেজ করতে হবে।

আপনার মতামত লিখুনঃ

সর্বশেষ সংবাদ